এ,এস,এম, রেজাউল করিম (পারভেজ) : সপ্তাহের সাত দিন এবং ২৪ ঘন্টা মায়েদের নরমাল ডেলিভারী, সিজার সহ বিভিন্ন ধরণের গুরুত্বপূর্ণ সেবা দিয়ে আস্থা এবং সুনাম কুড়াচ্ছে লক্ষ্মীপুর জেলা মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে গরীব, মধ্যবিত্ত ও ধনী রোগীরাও আসছেন সেবা নিতে।
তবে এই হাসপাতালটিতে রয়েছে জনবল সংঙ্কট। লক্ষ্মীপুর জেলা মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে সরকারি ভাবে ঔষধ সংকটও রয়েছে।এ ছাড়া দীর্ঘদিনের পুরনো ভবন হওয়ায় অনেকটা ঝুঁকি নিয়েই চলছে স্বাস্থ্যসেবা। তাই স্থানীয় এলাকায় বাসিসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার সচেতন মহল এই ভবনটি দ্রুত সংস্কার ও নতুন ভবনের দাবী তুলেছেন।
জেলা মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই রোগীদের সেবায় কাজ করে যাচ্ছে। এ হাসপাতালটির ঐতিহ্য অনেক পুরনো। বহু আগে থেকে হাসপাতালটির প্রতি লক্ষ্মীপুরের মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস রয়েছে।
গত কয়েকমাসেও এই হাসপাতালে সাড়ে তিনশতাধিক মায়ের স্বাভাবিক ডেলিভারী ও সিজার হয়েছে।
চিকিৎসা সেবায় হাসপাতালটি সুনাম কুড়ালেও বর্তমান জনবল সংকটের পাশাপাশি ভবনের অনেক জায়গায় দেয়াল ও ছাদ দুর্বল হয়ে পড়েছে। কোথাও দেয়াল,ছাদ বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। বর্ষা মৌসুমে ছাদের ফাটল দিয়ে বৃষ্টির পানি চুইয়ে পড়ার কথা শোনা গেছে।
লক্ষ্মীপুর জেলা মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের মেডিকেল অফিসার ডাক্তার আফরিন সুলতানা বলেন, জনবল কম হওয়ায় দায়িত্বপ্রাপ্ত স্টাফদের অনেক সময় ডাবল ডিউটি করতে হয়। এতে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।ডাক্তার আফরিন সুলতানা আরো বলেন,শহর ও প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে রোগীরা হাসপাতালে আসছেন সেবা নিতে। আমরা জনবল কম নিয়েও রোগীদের কাঙ্খিত সেবা দিয়ে যাচ্ছি। রোগীদের সেবা দেওয়ার ব্যাপারে কোন আপোষ নেই। যেকোনো মূল্যে আমরা সঠিক সেবা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছি।জনগণকে সেবা দেয়াই আমাদের মূল লক্ষ্য। এখানকার ডাক্তার এবং স্টাফরা রোগীদের কাঙ্খিত সেবা দিতে পারলেই খুশি।পরিশ্রম নিয়ে তারা তেমন একটা মন খারাপ করেন বলে মনে হয় না।
সাজ্জাদুল ইসলাম নামে এক প্রসূতির স্বামী বলেন, আমার স্ত্রীকে এই হাসপাতালে নিয়ে এসেছি। মেয়ে সন্তান হয়েছে।এখানকার স্টাফ পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা নাসরিন আক্তারের কাছ থেকে আমার স্ত্রী স্বাস্থ্য সেবা নিয়েছে। উনার আচরণ এবং চিকিৎসা সেবা অনেকটা উঁচু মানের।তার আচরণের কারণে নারী রোগীদের মনোবল বৃদ্ধি পায় এবং অনেকটা মনের জোরেই তাড়াতাড়ি সুস্থ্য হয়ে ওঠে বলে আমার মনে হয়।
টুমচর এলাকা থেকে আসা রোগী দিলরুবা বেগম বলেন,আমি ডাক্তার রুবিনা ইয়াসমিন ম্যাডাম থেকে চিকিৎসা নিচ্ছি।আমার প্রথম বাচ্চাটি পৃথিবীতে আসার বিষয়ে চিকিৎসা সেবা রুবিনা ইয়াসমিন ম্যাডাম দিয়েছেন।বর্তমানে আরেকটি শিশু আমার গর্ভে। আমি ঠিকমতো ওষুধ না খেলে, ঠিকমতো নিজের যত্ন না নিলে তিনি আমাকে মায়ের মতো আদর করে মিষ্টি ভাষায় শাসন করেন।এবং মধুর ভাবে বুঝান, শিশুটি ভালো ভাবে জন্ম নেয়ার জন্য আমাকে কতটা গুরুত্ব দিয়ে ওষুধ খেতে হবে এবং বিভিন্নভাবে নিজের যত্ন নিতে হবে।রোগীরা উনার চিকিৎসা সেবা যথেষ্ট সন্তুষ্ট। শুনেছি তিনি রিটায়ার্ড করবেন কিছুদিনের মধ্যে। খুব কষ্ট লাগছে এই মানুষটির জন্য। এ ধরনের মহৎ ডাক্তারদের জন্য লক্ষ্মীপুরের হাজার হাজার নারীও শিশুরা ভালো আছে। সুস্থ্য আছে।উনাদের সঠিক চিকিৎসা সেবার কারণে রোগীদের হৃদয়ে আস্থার জায়গা তৈরি করে নিয়েছেন।
বাগবাড়ি থেকে রুমি আক্তার নামের একজন প্রসূতি, ডাক্তার মোঃ নুরুজ্জামান এর কাছে চিকিৎসা নিয়েছেন।তিনি বলেন,ডাক্তার মোঃ নুরুজ্জামান অমায়িক ভদ্র মানুষ। রোগীদের নিজের মা বোনের মতোই আন্তরিকভাবে চিকিৎসা দেন। যে কারণে তিনি পুরুষ ডাক্তার হলেও নারীরা খুব সহজে উনার সাথে সমস্যা খুলে বলতে পারেন।এবং তিনি জটিল কঠিন সমস্যার খুব ভালো ও আধুনিক চিকিৎসা দিয়ে থাকেন।রুমি আক্তার আরো বলেন, আগে আমার বোন ও ননদের কাছ থেকে ওনার চিকিৎসার সুনাম শুনেছি।লক্ষ্মীপুর মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র এসে আমার মনে হলো ডাক্তার মোঃ নুরুজ্জামান সত্যি একজন ভালো চিকিৎসক।
এখানে সেবার মান ভালো।স্থানীয় ওষুধ ব্যবসায়ী সেলিম, সিকদার, সুজন ও মাকসুদের সাথে কথা বলে জানাযায়, দীর্ঘদিনের পুরনো এই লক্ষ্মীপুর উপজেলা মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের ভবনের অনেক স্থান দুর্বল হয়ে পড়েছে। এতে রোগীরা নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে। ভূমিকম্প হলে প্রাণের একটা ঝুঁকি থেকে যায়। সরকার হাসপাতালটি আবার নতুন করে করলে সবার জন্য ভালো হয়।
স্থানীয় ঔষধ ব্যবসায়ী বাসার, কামাল ও সোহেল জানান, লক্ষ্মীপুর উপজেলা মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র স্টাফ অনেক কম। হাসপাতালের স্টাফ বাড়ালে আরও ভালো সেবা পাওয়া যেত।যারা আছেন ওনারা রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়। তবুও স্টাফরা রোগীদের সাথে ভালো ব্যবহার করেন।কোন বিষয় না বুঝলে, কয়েকবার প্রশ্ন করলেও ওনারা ঠিকঠাক উত্তর দেন। রাগ হন না।
রুমি আক্তার নামে রোগীর স্বজন বলেন, আমি আমার ছোট বোনকে লক্ষ্মীপুর উপজেলা মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে নিয়ে এসেছি। চিকিৎসার জন্য কোন টাকা দিতে হয়নি।
হাসপাতাল স্টাফ আসমা সিদ্দিকা বলেন,লক্ষ্মীপুর জেলা মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র হাসপাতালের ভবন অনেক পুরনো। আমরা অনেক টেনশনে থাকি, ছোটখাটো ভূমিকম্প হলেও হাসপাতাল ভেঙে পড়তে পারে। ভবনটি আবার নতুন করে করা যায় কিনা ভেবে দেখা যেতে পারে।
স্টাফ রিনা দাস, আরজু মনোয়ারা,সবিতা প্রভা মজুমদারের ও আফ্রিনের সাথে কথা বলে জানা যায়, উপজেলা মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে জনবল অনেক কম। এজন্য ডাবল ডিউটি করতে হয়। পর্যাপ্ত জনবল থাকলে রোগীরা আরও ভালো সেবা পাবে। উপজেলা মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র ভবনটি অনেক পুরোন হওয়ায় ঝুঁকির মাঝে আমরা সবাই আছি, যে কোন সময় দুর্ঘটনা নিয়ে ভয়ে থাকি।
এছাড়া নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সূত্র জানায়, স্থানীয় কিছু মাদক সেবী ও বখাটেরা নানা ভাবে মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের ডাক্তার, কর্মচারী এবং রোগীদের বিরক্ত করে আসছে। তারা মাদক সেবন করে মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র এবং এর আশেপাশে বিভিন্ন রকমের ভয় ভীতি প্রদর্শন ও অসামাজিক কার্যকলাপ চালিয়ে থাকে।যার ফলে মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের ডাক্তার, স্টাফরা আতঙ্কিত থাকেন। সম্মান হানির ভয়ে মুখ খোলেন না কেউ। কিছু বললে নেমে আসো বিভিন্ন ধরনের মানসিক নির্যাত। দায়িত্বশীলদের এ ব্যাপারে জানিও তেমন কোন ফলাফল পাওয়া যায়নি বলে জানাযায়।
এ বিষয়ে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের উপ-পরিচালক নাজমুল হাসান বলেন,আমাদের ডাক্তার এবং স্টাফরা অন্যায় ভাবে কোন সমস্যা পড়লে আমরা চুপ করে থাকবো না। আমরা প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়ে নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নিব।এই ধরনের সমস্যার কথা আমিও শুনেছি। আমরা খোঁজখবর নিচ্ছি। মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রর সেবার বিষয়ে তিনি বলেন, এখানে মায়েদের স্বাভাবিক প্রসবের পাশাপাশি সিজারিয়ান সেবাও দেওয়া হয়। মাতৃমৃত্যু কমিয়ে আনার লক্ষ্যে লক্ষ্মীপুরের মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র কাজ করে যাচ্ছে। এই হাসপাতালে পরিবার কল্যান পরিদর্শিকা, জুনিয়র-সিনিয়র কনসাল্টেন্ট, শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ কিছু জনবল সংকট রয়েছে। জনবল বাড়লে সেবার পরিসরটা আরও বাড়বে। এ ছাড়া নতুন করে এই হাসপাতালগুলো প্রতিটি জেলায় ২০ শয্যা থেকে ৫০ শয্যা বিশিষ্ট করার প্রকল্প হাতে নিতে পারে সরকার। আমাদের এই হাসপাতালও সেই তালিকায় থাকলে রোগীরা বিভিন্নভাবে উপকৃত হবে।
Leave a Reply